ফল আমাদের দেশের একটি জনপ্রিয় উদ্যানতাত্ত্বিক ফসল । মানুষের খাদ্য তালিকায় ফল একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে । কিন্তু বাংলাদেশে ফলের উৎপাদন যথেষ্ট নয় বলে এর গুরুত্ব সেভাবে বিবেচনা করা হয় না । তবে কোনো দেশের জীবন যাত্রার মান নির্ভর করে সে দেশের মানুষের দৈনিক মাথাপিছু ফল খাওয়ার পরিমাণের ওপর । মরণাতীত কাল হতেই ফল আবাল বৃদ্ধবনিতা সকল মানুষের নিকট সুখাদ্য হিসেবে পরিচিত ও সমাদৃত । খ্রিষ্টপূর্ব ৭০০০ বছর পূর্বে খেজুর চাষ এর সাক্ষ্য বহন করে । মুঘল সম্রাট আকবর কর্তৃক এক লক্ষ আম গাছের বাগান তৈরি, পর্তুগিজদের দ্বারা ভারতীয় উপমহাদেশে আনারস ও পেঁপে চাষের প্রবর্তন ইত্যাদি হতে বোঝা যায় যে ফলের প্রতি মানুষের আগ্রহ অতীত কাল থেকেই ছিল । বিভিন্ন ধর্ম গ্রন্থে ফলকে বেহেস্তি খাবার হিসেবে চিহ্নিত করা হয় । ফলের স্বাদের প্রতি আমরা সবাই অনুরাগী হলেও অনেকে এর পুষ্টি মূল্য এবং ফল খাওয়ার প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে ওয়াকেবহাল নই। ফল মানুষের পুষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় ভিটামিন এবং খনিজ পদার্থে ভরপুর । অন্যান্য খাবারের পরিপূরক হিসেবে ফল খাওয়া যায়। অধিকাংশ ফল দেখতে আকর্ষণীয়, সুস্বাদু এবং সকলের কাছে পছন্দনীয়। ফল রান্না ছাড়া সরাসরি খাওয়া যায় বলে এর পুষ্টিমান নষ্ট হয় না । তাই ফলের ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ সবটুকুই শরীর গ্রহণ করতে পারে । ফল প্রচুর পরিমাণ খেলেও তেমন কোন অসুবিধা হয় না এবং পুষ্টিতে কোন সমস্যা থাকে । ফলে বিশেষ করে ক্যারোটিন (যা ভিটামিন 'এ' তে রূপান্তরিত হয়), ভিটামিন 'সি', ক্যালসিয়াম, লৌহ ও অন্যান্য উপাদান যথেষ্ট পরিমাণে আছে । তাই মানব দেহের পুষ্টিতে ফলের অবদান অনেক বেশি। খাদ্য ঘাটতি পূরণেও ফল গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে । উন্নত দেশের মানুষ আমাদের তুলনায় বেশি পরিমাণে ফল খায় বলে তাদের স্বাস্থ্য অনেক ভালো, সুঠাম দেহের অধিকারী এবং তারা দীর্ঘদিন বেঁচে থাকে।
পুষ্টিহীনতা দূরীকরণে, চিকিৎসা কাজে, খাদ্য ঘাটতি পূরণে, নুতন শিল্প স্থাপনে, কাজের সুযোগ সৃষ্টিতে, আয় বৃদ্ধিতে, জীবন যাত্রার মান উন্নয়নে, সামাজিক কর্মকাণ্ডে, রুচির পরিবর্তনে এবং পরিবেশ সংরক্ষণে ফল বিভিন্ন ভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে ।
আমাদের প্রতিদিন মাথাপিছু কমপক্ষে ১১৫ গ্রাম করে ফল খাওয়া উচিত। কিন্তু সেখানে আমরা পাই প্ৰায় ৩৮ গ্রাম । বাংলাদেশে ফল চাষের আওতায় জমির পরিমাণ এবং মোট উৎপাদনের পরিমাণ খুব ধীরগতিতে বৃদ্ধি পাছে । অপরদিকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বেশি হওয়ায় মাথাপিছু ফল খাওয়ার পরিমাণ বাড়ার চেয়ে কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশের অধিকাংশ ফলই ব্যবসায়িক বা বাজার চাহিদার ভিত্তিতে বেশি করে চাষাবাদ করা যায় না । যার ফলে প্রকৃতপক্ষে চাষের আওতায় জমির পরিমাণ নির্ণয় করা কঠিন । মনে করা হয় বাংলাদেশের মোট চাষভুক্ত জমির মধ্যে ফলের আওতায় ১ - ২ % জমি আছে। অথচ জাতীয় অর্থনীতিতে মোট ফলভিত্তিক আয়ের ১০% আসে ফল থেকে। বর্তমান বিশ্বে ফলের পুষ্টি মূল্য ছাড়াও ফলের অর্থনৈতিক গুরুত্ব যথেষ্ট । বাজারে ফলের চাহিদা ছাড়াও মূল্য বেশি বিধায়, এটি চাষাবাদে অতিরিক্ত আয় নিশ্চিত হয়। যার ফলশ্রুতিতে ফল উৎপাদনের সাথে জড়িত সম্প্রদায়ের আর্থিক সচ্ছলতা আসে ও জীবনযাত্রার মান উন্নত হয় । অধিক ফল উৎপন্ন করে এবং তা রপ্তানি করে দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা করা সম্ভব ।
ফলের সংজ্ঞা ও প্রকার ভেদ
উদ্ভিদ বিজ্ঞানীদের মতে ফল হলো ফুলের নিষিক্ত এবং পরিণত ডিম্বাধার । ফল গঠনে নিষেক উদ্দীপকের কাজ করে । আর সে জন্যই নিষেকের পর হতেই ফুলের গর্ভাশয় বা ডিম্বাশয়টি পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত হয়ে ধীরে ধীরে পরিপূর্ণতা লাভ করে পূর্ণাঙ্গ ফলে পরিণত হয় । ডিম্বাশয়টি বীজ ধারন করে । নিষিক্তকরণ ছাড়াও ফুলের ডিম্বাশয় বা অন্য কোন অংশ বর্ধিত ও পরিপষ্ট হয়ে ফলে পরিণত হতে পারে। কলা, আপেল, চালতা, হলো এমন ধরনের ফলের উদাহরণ । নিষেক ক্রিয়া ছাড়া সৃষ্ট ফলে বীজ হয় না। সচরাচর ফল একটি মাত্র ফুল হতে উৎপন্ন হয় । কিন্তু কোন কোন ক্ষেত্রে ফুলের সমপূর্ণ অংশ যেমন – বৃত্তি, পাপড়ি, পুপাক্ষ, সম্পূর্ণ পুষ্প মঞ্জুরী - ফল গঠনে অংশগ্রহণ করে ।
ফুলের পুংকেশরের পরাগধানী হতে তৈরি পরাগরেণু পুংজনন কোষ উৎপন্ন করে। অন্যদিকে স্ত্রীকেশরের ডিম্বাশয়ের ভেতরে অবস্থিত ডিম্ব থেকে উৎপন্ন হয় স্ত্রীজনন কোষ । উপযুক্ত পুং এবং স্ত্রী জননকোষ একত্রে মিলিত হওয়াকে নিষেক বলে। নিষেকের পূর্বে পুংকেশরের পরাগ রেণু স্ত্রীকেশরের গর্ভমুন্ডে বিভিন্ন উপায়ে পতিত হয় । এ পতিত হওয়াকে পরাগায়ন বলে । ফুল হতে ফল গঠনে নিষেক প্রক্রিয়ায় ফুলের বিভিন্ন অংশের অংশগ্রহণের ওপর ভিত্তি করে ফলকে দু'ভাগে ভাগ করা যায় । যথা – ক) প্রকৃত ফল ও খ) অপ্রকৃত ফল ।
ক) প্রকৃত ফল: নিষেকের পর ফুলের শুধু ডিম্বাশয়টি ফলে পরিণত হলে তাকে প্রকৃত ফল বলে । এতে ফুলের অন্য কোন অংশ ফল গঠনে অংশগ্রহণ করে না। যেমন – আম, জাম, নারিকেল, লিচু, পেঁপে, পেয়ারা ইত্যাদি ।
খ) অপ্রকৃত ফল: নিষেকের পর ফুলের সাহায্যকারী অংশসমূহ ফল গঠনে অংশগ্রহণ করে যে ফল গঠন করে তাকে অপ্রকৃত ফল বলে । এতে ফুলের সাহায্যকারী অংশসমূহ যেমন— — বৃতি, দলমণ্ডল ইত্যাদি ফল গঠনে অংশগ্রহণ করে । যেমন – আপেল, কাঁঠাল, চালতা, আতা ইত্যাদি। এছাড়াও আর এক ধরনের ফল পাওয়া যায় । যথা পারথেনাকোরপিক ফল ।
গ) পারথেনোকারপিক ফল: এ ফলে ডিম্বাশয় নিষিক্ত না হয়ে ফলে রূপান্তরিত হয় । এতে কোন বীজ থাকে না । যেমন—আনারস, আঙ্গুর, কলা ইত্যাদি ।
সাধারণত একটি আদর্শ ফলের দুটি অংশ থাকে । যেমন – ক) ফলত্বক ও খ) বীজ
ক) ফলত্বক ও এটি ফুলের গর্ভাশয়ের প্রাচীর বা বহিরাবরণ । আদর্শ ফলের ফলত্বক সাধারণত দু'ধরনের । (১) পুরু ও রসালো এবং (২) পাতলা ও শুস্ক
১। পুরু ও রসালো
এ ফলত্বককে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। উদাহরণ- আম, জাম, কুল ইত্যাদি এ ধরনের ফল। ভাগ গুলো হলো- (ক)- বহিত্বক (খ)- মধ্যত্বক ও (গ) - অন্তত্বক
ক) বহিত্বকঃ এটি ফলের সবচেয়ে বাইরের স্তর । এ স্তর মসৃণ ও চামড়ার ন্যায় ।
(খ) মধ্যত্বক: এ স্তর বহিত্বকের নিচের স্তর। এ তর মাংসল ও রসালো। তবে ফলভেদে এই মাংসল স্তরের পুরুত্ব কম বা বেশি হতে পারে।
(গ) অন্তত্বক: এ স্তর ফলের সবচেয়ে ভেতরের স্তর। পরিপুষ্ট ফলে এ স্তর বেশ গুরু ও শক্ত হয়। এ স্তর বীজপত্রকে আবৃত করে রাখে ।
২। পাতলা ও শুস্ক ত্বক
ফলের এ ত্বক পাতলা ও এ এবং বীত্বক ফলত্বকের সাথে লেগে থাকে। বীজত্বক ও ফলত্বক বাদে বাকি অংশ অন্তবীজ বা শস্য । উদাহরণ- ধান, গম, ভুট্টা, সরগাম, চিনা, কাউন ইত্যাদি ।
ক) বীজঃ এটি অন্তত্বক দ্বারা আবৃত থাকে। বীজে দুটি পুরু ও মাংসল বীজপত্র থাকে। কিন্তু বীজপত্র কিছুটা শক্ত।
ফলের শ্রেণিবিন্যাস
ফলের পরিচিতি ও ফল সম্পর্কে সম্যক জ্ঞানার্জনের জন্য ফলের শ্রেণিবিন্যাস সম্পর্কে কিছুটা জানা আবশ্যক। কেননা ফলকে বিভিন্নভাগে ভাগ করা হয়েছে। যেমন—
১। ফলের বীজপত্রের (Cotyledon) সংখ্যার ভিত্তিতে
ক) একবীজপত্রী ফল ভাল, নারিকেল, সুপারী, খেজুর ইত্যাদি ।
খ) দ্বিবীজপত্রী ফল: আম, গাব, কাঁঠাল ইত্যাদি ।
গ) বহু বীজপত্রী ফল পেঁপে, কাঁঠাল, পেয়ারা, তরমুজ ইত্যাদি ।
পরাগায়ণের ভিত্তিতে
ক) স্ব - পরাগী ফল ও আমলকী, পেয়ারা, আংগুর, সফেদা, ডুমুর ইত্যাদি
খ) পর পরাগী ফল আম, জাম, লিচু, পেঁপে, তাল, সুপারী খেজুর, আনারস, কূল, অ্যাভোকেডো ইত্যাদি ।
গ) স্ব ও পর পরাগী ফল কাঁঠাল, নারিকেল, লেবু জাতীয় ফল, কাজুবাদাম, ডালিম ইত্যাদি ।
৩। জীবনকালের ভিত্তিতে
ক)স্বল্প মেয়াদি ফল: কলা, পেঁপে, আনারস, তরমুজ ইত্যাদি
খ) দীর্ঘমেয়াদি ফল: আম, জাম, কাঁঠাল, নারিকেল ইত্যাদি
৪। গাছের ফল প্রদানের প্রকৃতি অনুসারে
ক) মনোকারণিক ফল: কলা, শসা, তরমুজ, বাঙ্গী ইত্যাদি।
খ) পলিকারণিক ফল: আম, জাম, কাঁঠাল ইত্যাদি।
৫। উৎপত্তি বা উৎস অনুসারে
ক) প্রকৃত ফল আম, জাম, কালোজাম, লিচু, লেবু, পেঁপে ইত্যাদি
খ) অপ্রকৃত ফল: আপেল, নাশপাতি, কাজুবাদাম ইত্যাদি ।
গ) পারথেনোকারণিক ফল: আনারস, আঙ্গুর, কলা ইত্যাদি।
৬। পুষ্পমঞ্জুরীর ভূমিকার ওপর ভিত্তি করে
ক) সরল ফলঃ আম, জাম, নারিকেল, কলা ইত্যাদি ।
খ) যৌগিক ফল: যৌগিক ফল আবার দু'প্রকার
i) এগ্রিগেট বা গুচ্ছ ফল: আতা, শরীফা, রাস্পবেরী, কাঁঠালী চাপা ইত্যাদি
ii) মাল্টিপল ফল কাঁঠাল, আনারস ইত্যাদি।
৭। পেরিকার্পের বুনটের ওপর ভিত্তি করে (Texture of the pericarp)
ক) নীরস বা শুষ্ক ফল : কাঠবাদাম, সুপারি, এপ্রিকট ইত্যাদি ।
খ) সরস ফল: সরস ফল আবার পাঁচ প্রকার
i) ডুপ: আম, কুল, নারিকেল ইত্যাদি
ii) বেরী: কলা, পেয়ারা, কালোজাম, গোলাপজাম ইত্যাদি ।
iii) পামে: আপেল, নাশপাতি ইত্যাদি
iv) পেপো: শসা, তরমুজ, বাঙ্গি ইত্যাদি।
v) হেসপেরিডিয়াম: কমলা লেবু, কাগজী লেবু, বাতাবী লেবু ইত্যাদি ।
৮। জলবায়ুর চাহিদার ওপর ভিত্তি করে
ক) উষ্ণ মণ্ডলীয় ফল খেজুর, অ্যাভোকেডো, কলা, নারিকেল, আম, কাঁঠাল ইত্যাদি
খ) অউষ্ণমণ্ডলীয় ফল: পেয়ারা, ডালিম, কুল, কলা, জলপাই, লেবু জাতীয় ফল, অ্যাভোকেডো ইত্যাদি ।
গ) শীত মণ্ডলীয় ফল: স্ট্রবেরী, রাশবেরী, পীচ, ইউরোপীয় আঙ্গুর ইত্যাদি ।
বাংলাদেশের ফলের তালিকা
বালাদেশে উৎপন্ন ফলগুলোর ধরন ও গোত্র অনুযায়ী শ্রেণিবিভাগ করে নিয়ে একটি নাতিদীর্ঘ তালিকা দেয়া হলো
ক) আম গোত্র ভুক্ত: আম, আমড়া, বিলাতি আমড়া ও কাজু বাদাম।
খ) কাঁঠাল গোত্র ভুক্ত : কাঁঠাল, ভেটরা, ডুমুর, তুতফল, রুটীফল ও ডুরিয়ান ।
গ) লিচু গোত্র ভুক্ত: লিচু, আঁশফল ও রাম্বুটান।
ঘ) পেয়ারা গোত্র ভুক্ত: পেয়ারা, জাম, জামরুল ও গোলাপজাম ।
ঙ) অন্যানো জাতীয়: শরিফা ও আতা।
চ) সফেদা গোত্রভুক্ত: সফেদা, বকুল ও মহুয়া ।
ছ) লেবু জাতীয়: লেবু, কাগজি লেবু, জামির, বাতাবি লেবু, কমলা লেবু ও সাতকরা ।
জ) বেল জাতীয়ঃ বেল ও কদবেল ।
ঝ) টক-প্রধান: কুল, তেঁতুল, আমলকী, কামরাঙা, বিলিম্বি, জলপাই, চালতা, করমচা ও লৌহ ।
ঞ) আপেল জাতীয়: পিচ, নাশপাতি, চেরি ও ও ট্রপিক্যাল আপেল ।
ট) অন্যান্য বৃক্ষ জাতীয় ফল: অ্যাভোকেডো, বইচি, পানিয়াল, কাউফল, গাব, লটকন ও ডালিম ।
ঠ) লতা জাতীয়: প্যাসল ফল ও আঙ্গুর ।
ড) পাম জাতীয়: নারিকেল, তাল ও খেজুর ।
ঢ) অবৃক্ষ জাতীয়: কলা, পেঁপে, আনারস, তরমুজ, ফুটি, স্ট্রবেরি ও পানি ফল ।
এগুলোর মধ্যে ৫-৬টি ফল বিদেশ থেকে সাম্প্রতিককালে আনীত (প্যাকেন, রাম্বুটান, স্ট্রবেরি, অ্যাভোকোডা)
সারণি-১ দেশের মাটিতে সাম্প্রতিক প্রবর্তিত ও চাষযোগ্য বিদেশি ফল ও জাতের নাম
১. পিচ (Prunus persica)
এদেশে সৈয়দপুর, নীলফামারিতে প্রথম এক নার্সারিতে প্রচুর ফল ধরা পিচ ফলের একটি গাছ দেখে বিশ্বাস হয় যে এ দেশে পিচ ফল হওয়া সম্ভব । স্থানীয় বাসিন্দারা পীচ ফলের নাম বলেছিল মাজু ফল । এ নামে পিচ ফলের কোন বাংলা বা থানীয় নাম আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি । কিন্তু এর ইংরেজি নাম Peach, এ নামটাই এ দেশেও পরিচিত হয়ে উঠেছে। পরে অবশ্য সাভার, গাজীপুর, সৈয়দপুর, নীলফামারী, দিনাজপুর, চট্টগ্রাম ইত্যাদি এলাকায় ফলধরা বেশ কিছু পিচ ফলের গাছ চোখে পড়েছে। তবে প্রকৃতপক্ষে ফলটি শীতপ্রধান এলাকায় ভালো জন্মে । ভারতের সিমলাতে অনেক পীচ ফলের গাছ আছে। পিচ গাছ মাঝারি আকারের বৃক্ষ, পাতা অনেকটা ডালিম বা শরিফা পাতার মতো দেখতে । পাতার গোড়ায় অনেক ছোট ছোট পাতা থাকে । ফুলের রঙ লাল বা গালোপি । ফল দেখতে ডিম্বাকার তবে মুখটা আমের মতো বাকানো ও সুচালো । কাঁচা ফলের রঙ সবুজ পাকলে হালকা হলুদের ওপর লাল আভা সৃষ্টি হয় । কাচা ফল শক্ত, খোসা খসখসে। কিন্তু পাকলে নরম হয়ে যায় ও টিপ দিলে সহজে ভেঙে যায় । পাকা ফলের রসালো শাস হালকা হলুদ ও ভেতরের দিকে লাল, শাসের স্বাদ টক । ফলের মধ্যে খয়েরি রঙের একটা শক্ত বিচি থাকে । পিচ ফল পাকে মে - জুন মাসে । এক কেজি ফল থেকে প্রায় ৪৭০ ক্যালরি শক্তি পাওয়া যায় । চোখ কলম করে পিচ ফলের বংশবৃদ্ধি সম্ভব ।
২. অ্যাভোকেডো
অ্যাভোকেডো আসলে আমেরিকার ফল । সে দেশে সুপ্রাচীনকাল থেকে অ্যাভোকেডো চাষ হয়ে আসছে । ইনকা সভ্যতার আমলেই অ্যাভোকেডোর পুষ্টি ও খাদ্যমান নির্ণিত হয়েছিল । এখন সারা বিশ্বে অ্যাভোকেডো ইংরেজি নামেই পরিচিত। বাংলা কোন নাম নাই। কিন্তু ফলটি যেভাবেই হাকে সমতল বাংলার মাটিতেও ফলে । গাজীপুরের কালিয়াকৈর, চাপাইনবাবগঞ্জে কল্যাণপুর হর্টিকালচার সেন্টার ও ময়মনসিংহের ভালুকায় লাগানো অ্যাভাকেডো বৃহৎ আকারের গম্বুজ আকৃতির চিরসবুজ গাছ। গাছ ১৮ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয় । পাতা সরল তবে আকার আকৃতিতে ভিন্নতা দেখা যায় । পাতা ১০-৪০ সেন্টিমিটার লম্বা হয়। ছোট ছোট হালকা সবুজ রঙের ফুল ফোটে থাকা ধরে। ছড়ায় ফুল ঝুলতে থাকে। ডালের আগায় সাধারণত ফুল ফোটে। অ্যাডভোকেডোর লাখ লাখ ফুল ফোটে, কিন্তু আমের মতোই ফল হয় খুব কম ফুল থেকেই । ফোটা ফুলের মাত্র ০.১ শতাংশ ফুল থেকে ফল হয় । কারণ দিনের এক সময় ফোটে পুরুষ ফুল, অন্য সময় ফোটে স্ত্রী ফুল । ফুল ফোটে শরতের শেষে এবং ফল পরিণত হতে ৬-১২ মাস লেগে যায়। অ্যাভোকেডো ফল বেশ বড়, প্রতিটি ফলের ওজন ১-৩ কেজি পর্যন্ত হয় । ফলের ভেতরে একটা বড় শক্ত বীজ থাকে বীজের চারদিকে থাকে শাস । শাঁসের ওপরে থাকে চামড়ার মতো খোসা। দেখতে অনেকটা নাশপাতির মতো আকার। তবে গোলাকার জাতেরও আছে । ফলের রং সবুজ বা হলদে সবুজ থেকে হলুদ ।
৩. স্টার আপেল
আজকাল প্রায়শই কিছু নার্সারির লোকেরা একটি গাছকে আপেল গাছ বলে চালিয়ে দিচ্ছে। যে গাছটিকে আপেল গাছ বলা হচ্ছে, সেটি আপেল নয়, তারকা ফলের গাছ। এ দেশে আপেল হবে না। কারণ আপেল জন্মাতে বছরের একটা নির্দিষ্ট সময় বরফ পড়তে হয় । তারকা ফলের নামের সাথে যে আপেল শব্দটা রয়েছে সেটা মুখে মুখে রটতে রটতে স্টার গিয়ে বসেছে আকাশের তারা হয়ে, হয়ে গেছে আপেল । তা ছাড়া তারকা ফল দেখতেও অনেকটা সবুজ আপেলের মতো। তাই, একে আপেলের ভাই বলে। এ দেশে আপেল হয় না সত্য তবে স্টার আপেল হয়। গাজীপুরে বিএআরআইয়ের উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রে স্টার আপেলের বয়সী গাছটাতে যেভাবে ডাল ভেঙে ফল ধরেছে, তাতে অবাক না হয়ে পারা যায় না। তা থেকে আশা করা যায় এ দেশেও ভালো ফল ফলতে পারে । তারকা ফলের গাছ বৃহৎ আকারের শোভাময়ী বৃক্ষ । গাছ ১০ মিটার পর্যন্ত উঁচু হয় । পাতা দোরঙা । অর্থাৎ ওপরের পিঠ গাড় সবুজ ও নিচের পিঠ মেরুন বাদামি । পাতা কিছুটা ডিম্বাকার, বর্শার ফলার মতো ।
দ্রুত উৎপাদনশীল ফলের তালিকা
পৃথিবীতে শত শত প্রকার ফল জন্মে । এদের মধ্যে কতগুলো গ্রীষ্ম মন্ডলীয় (Tropical), কতগুলো প্ৰায়গ্ৰীষ্ম মন্ডলীয় (Subtropical) এবং কতগুলো নাতিশীতাষ্ণ জলবায়ু (Temperate) উপযোগী । অবশ্য কোন কোন ফল গ্রীষ্ম প্রধান হতে প্রায় গ্রীষ্মপ্রধান পর্যন্ত এবং কোনটি প্রায়গ্রীষ্ম প্রধান হতে নাতিশীতাষ্ণে জলবায়ু পর্যন্ত বিস্তৃত । বাংলাদেশে গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলের প্রায় সকল ফল এবং প্রায় গ্রীষ্ম প্রধান অঞ্চলের কোন কোন ফল জন্মে । বাংলাদেশে অনেক ধরনের ফল গাছ জন্মে । তবে যে সব ফলের ব্যাপক চাষ হয় বা ব্যবসায়িক ভিত্তিতে চাষ করা হয় সেগুলো হচ্ছে - আনারস, কলা, পেঁপে, আম, লিচু, কাঁঠাল, পেয়ারা, কুল, তরমুজ, ফুটি, লেবু - জাতীয় ফল, নারিকেল ও স্ট্রবেরী । এগুলোর মধ্যে কলা, পেঁপে, আনারস, তরমুজ, ফুটি, দ্রুত বর্ধনশীল অবৃক্ষ ', জাতীয় ফল । কুল, পেয়ারা ইত্যাদি বৃক্ষ জাতীয় দ্রুত বর্ধনশীল ফল। পরিসংখ্যান অনুযায়ী এদেশের মোট উৎপাদিত ফলের প্রায় ৫০ ভাগের অধিক দ্রুত বর্ধনশীল স্বল্প মেয়াদী গাছ থেকে উৎপন্ন হয় । আবার দ্রুত বর্ধনশীল ফলের শতকরা ৭০ ভাগই হচ্ছে কলা । দ্রুতবর্ধনশীল ফল গুলোর মধ্যে আনারস, কলা, পেঁপে, তরমুজ ও ফুটি স্বল্প মেয়াদী ফল গাছ হিসেবে পরিচিত । কারণ খুব অল্প সময়েই অর্থাৎ কয়েক মাস থেকে শুরু করে এক বা দুবছরের মধ্যেই এগুলো ফল দিয়ে থাকে এবং খুব দীর্ঘস্থায়ী বা দীর্ঘজীবি নয় ।
কয়েকটি দ্রুত বর্ধনশীল ফলের পরিচিতি
১। আনারস (Pineapple )
আনারস টক-মিষ্টি, রসালো যৌগিক ফল যা সরোসিস নামে পরিচিত। এর উৎপত্তি হল দক্ষিণ আমেরিকার ব্রাজিল বা প্যারাগুয়ে অঞ্চলে । বাংলাদেশের টাঙ্গাইল (মধুপুর), সিলেট ও পাবর্ত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে এর ব্যাপক চাষাবাদ হচ্ছে । আনারসের তিনটি জাত হানিকুইন, জায়ান্ট কিউ ও ঘোড়াশাল বাংলাদেশে বহুল প্রচলিত । গাছ দ্বিবর্ষজীবি এবং একটি গাছ একবার মাত্র একটি ফল দিয়ে থাকে। পাঁচ রকমের সাকার দিয়ে অঙ্গজ পদ্ধতিতে এর বংশ বিস্তার করা হয় । যেহেতু বেশির ভাগ চারা আশ্বিন-কার্তিকে পাওয়া যায় সেহেতু চারাগুলো পৌষ মাঘে রোপণ করতে হয় । আনারসের শেকড় মাটির গভীরে যায় না । সুতরাং বাগানে আগাছা পরিষ্কার রাখা জরুরি । রোপণের পর ১৪-১৬ মাস বয়সের গাছে ফুল আসে । সাধারনত: ৬০ ভাগ গাছে ফল আসে । তবে ইথরেল ৫০০ পিপিএম বা ক্যালসিয়াম কার্বাইড ১০,০০০ পিপি এম প্রয়োগে শতকরা ৮০-৯০ ভাগ গাছে ফল আসে । হেক্টর প্রতি ৩০-৫০ টন ফলন হয় । যথাযথ পরিচর্যা করলে দুটি মুড়ি ফসল পাওয়া যায় ।
২। পেঁপে (Papaya )
পেঁপে উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়ায় ভালো জন্মে । গাছ সারা বছরই ফুল ও ফল দিয়ে থাকে । সামান্য সময়ের জন্য হলেও জলাবদ্ধতা গাছের মারাত্মক ক্ষতি করে থাকে । পুরুষ ও স্ত্রীফুল আলাদা গাছে থাকে । পেঁপে পরপরাগায়িত ১. এবং বীজ দ্বারা বংশ বিস্তার হয়ে থাকে বলে অসংখ্য প্রকারের পেঁপে দেখা যায় । বিশেষ কোনো জাত আবাদ ও সংরক্ষণ করতে হলে নিয়ন্ত্রিত পরাগায়নের মাধ্যমে বীজ উৎপাদন করা উচিত । প্রতি গর্তে তিনটি পেঁপে চারা রোপণ করা হয় । তাহলে প্রতি গর্তে অন্তত একটি স্ত্রী গাছ পাওয়া যায় । বাগানের শতকরা ন্যূনতম ৫ ভাগ পুরুষ গাছ পরাগায়নের সুবিধার্থে থাকা প্রয়োজন । সেচের ব্যবস্থা থাকলে আশ্বিন মাঘ মাস চারা রোপণের উত্তম সময় । তাছাড়া মৌসুমি বৃষ্টি শুরু হলে জ্যৈষ্ঠ মাস ভালো সময় । রোপণের ৪/৫ মাস পরে ফুল দেখে স্ত্রী বা পুরুষগাছ চেনা যায় । তখন গর্তে একটি স্ত্রী গাছ রেখে বাকিগুলো উপড়ে ফেলতে হয় । ফল ধরার দুমাস পরেই সবজি হিসেবে খাওয়া যায় । পাকা খাওয়ার জন্য গাছে পেঁপের গায়ে একটু হলুদ রং দেখা দিলেই আহরণ করা উচিত । পেঁপের ফলন গাছ প্রতি ১৫-২৫ কেজি এবং হেক্টর প্রতি ৩০--৩৫ টন হতে পারে ।
৩। কলা (Banana )
কলা উষ্ণ ও আর্দ্র অঞ্চলের ফল । কলা সাধারণত পাকা ফল হিসেবে খাওয়া হয় । কলার অনেক জাত আছে যেগুলো সবজি হিসেবে খাওয়া হয়। আফ্রিকার অনেক উপজাতির প্রধান খাদ্য কলা। কলাচাষের অনুকূল তাপমাত্রা ১৫-৩৫° সেলসিয়াস। প্রতিমাসে ২০ সে.মি. বৃষ্টিপাত গাছের বৃদ্ধির জন্য উত্তম । কলাগাছ ঝড়াবোতাস সহ্য করতে পারে না। কলার সাধারণত অঙ্গজ পদ্ধতিতে বংশ বিস্তার হয়ে থাকে । কলার জাতসমূহ তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত যথা-১ । পাকা অবস্থায় ভক্ষণ যোগ্য বীজহীন জাতসমূহ ২। বীচি কলা বা আটি কলার জাতসমূহ ৩। আনাজী বা সবজি হিসেবে ব্যবহৃত কলার জাতসমূহ । সেচের ব্যবস্থা থাকলে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর বা জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে সাকার রোপণের উত্তম সময় । মুড়ি ফসল কলাচাষের একটি বাড়তি সুবিধা । হেক্টর প্রতি সাধারণত ২০-২৫ টন ফলন পাওয়া যায় ।
ফল গাছের বাংলা, ইংরেজি ও উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম
পৃথিবীতে বহু ধরনের ভাষা প্রচলিত থাকায় একই উদ্ভিদ বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামে পরিচিত । যেমন — আম, গাছকে বাংলায় আম বা আম্র, গুজরাটিতে আমরি, পুর্তুগীজে ম্যাংগা, ফরাসীতে ম্যাংগু, চীনা ভাষায় ম্যাংকে, এবং ইংরেজিতে ম্যাংগো বলা হয় । শুধু তাই নয় দেখা গেছে একই ভাষা ভাষীরাও একই ফলকে বিভিন্ন নামে অভিহিত করে থাকে। তাই এ অসুবিধা দূর করার জন্য International Code of Binomial Nomenclature (ICBN) নীতি অনুসরণ করে প্রতিটি উদ্ভিদের আন্তর্জাতিকভাবে নামকরণ করা হয়েছে । উক্ত নামটি ল্যাটিন ভাষায় এবং রোমান অক্ষরে লিখতে হয় । অন্য ভাষায় হলে লাটিনের মত করে লিখতে হয় । প্রতিটি নামের দুটি অংশ আছে - একটি জেনেটিক ইপিথেট বা গণের অংশ অপরটি স্পেসিস ইপিথেট বা প্রজাতির অংশ । জেনেটিক অংশ বড় হাতের অক্ষর দিয়ে শুরু হয় । উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম ল্যাটিন শব্দে না লেখা হলে জেনিটিক ও স্পেসিস নামের নিচে পৃথক পৃথকভাবে দাগ (Under line) দিতে হবে । উদ্ভিদতাত্ত্বিক নামের শেষে এর প্রবর্তকের নামও লিখতে হয় । এটিই দ্বিপদ নামকরণ পদ্ধতি । নিচের সারণিতে ফল গাছের বাংলা, ইংরেজি, উদ্ভিদতাত্ত্বিক ও পরিবারের নাম দেয়া হলো
সারণি-২ ও ফল গাছের বাংলা, ইংরেজি, উদ্ভিদতাত্ত্বিক ও পরিবারের নাম
অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১ । আমাদের প্রতিদিন মাথাপিছু কমপক্ষে কত গ্রাম ফল খাওয়া উচিত ।
২। বাংলাদেশের মোট চাষভুক্ত জমির মধ্যে ফলের আওতায় জমির পরিমাণ শতকরা কতটুকু ?
৩। নিষেক প্রকিয়ার উপর ভিত্তি করে ফলকে কত ভাগে ভাগ করা যায় ।
৪ । আমাদের দেশে স্বল্প মেয়াদী ফল কোনগুলো।
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১। ফল বলতে কি বোঝায় ?
২। নিষেক প্রক্রিয়ার ওপর ভিত্তি করে ফলকে কয়টি ভাগে ভাগ করা যায় ?
৩। আদর্শ ফলের কয়টি অংশ থাকে চিত্র অঙ্কন করে দেখাও ।
৪। মানুষের পুষ্টি সরবরাহে ফল কীভাবে অবদান রাখে লেখ ।
৫ । উদ্ভিদ তাত্ত্বিক নামসহ ৫টি ফলের বাংলা ও ইংরেজি নাম লেখ ।
রচনামূলক প্রশ্ন
১ । ফল বলতে কি বোঝায়। ফলের শ্রেণি বিন্যাস গুলোর নাম লেখ এবং প্রত্যেকটির উদাহরণ দাও ।
২। বাংলাদেশে প্রচলিত দেশি ফলের একটি তালিকা তৈরি কর ।
৩। বাংলাদেশের মাটিতে সাম্প্রতিক প্রবর্তিত চাষযোগ্য ১০টি বিদেশি ফলের নাম, উদ্যানতাত্ত্বিক নাম, পরিবার, জাত ও উৎপত্তি স্থান লেখ ।
৪ । টিকা লেখ: ক) প্রকৃত ফল খ) অপ্রকৃত ফল গ) মনো ও পলিকারপিক ফল ঘ) উদ্যানতাত্ত্বিক ফল ঙ) একবীজপত্রী ফল চ) ব - পরাগী ও পরপরাগী ফল ।
Read more